আজ শনিবার, ২০শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৪ঠা জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

নগরজুড়ে বাড়ছে পরিকল্পিত হত্যা

সংবাদচর্চা রিপোর্টঃ

নারায়ণগঞ্জ জেলা জুড়ে পরিকল্পিত হত্যকান্ডের ঘটনা দিনকে দিন বেড়েই চলছে। ঘাতকদের পরিকল্পনার কৌশল হিসেবে প্রথমে ভিকটিমকে প্রলোভন কিংবা বিভিন্ন কাজের কথা বলে ঘটনাস্থলে নিয়ে আসা। পরবর্তীতে সঠিক সময় দেখে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে। হত্যার পর আলামত বিনষ্ট করার লক্ষে করা হচ্ছে লাশকে খন্ড বিখন্ড নয়তো মৃত দেহটি চিরতরে গুম করার লক্ষ নিয়ে ঘাতকরা নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যা নদী কিংবা দীর্ঘ মাটি খুড়ে মাটির ভূগর্ভস্থে মানব দেহটিকে পুতে রাখছে। আর এভাবেই ঘাতকদের পরিকল্পনার সু-কৌশল বাস্তবায়িত হচ্ছে দিনের পর দিন। তবে কথায় আছে সত্য কখনো চাপা থাকে না। আর সেই সত্য যদি হয় মানব হত্যার, সেটা আজ বাদে কাল প্রকাশ পাবে।

এ সকল নৃশংস হত্যাকন্ডের ঘটনার খুব বেশীদিন গোপন থাকতে পারে না। হিত্যাকান্ডের ঘটনাটি যখনি প্রকাশ্যে আসছে তখন নৃশংস হত্যার শিকার মানব দেহটির অবস্থা অত্যন্ত করুন পাওয়া যায়। মৃত দেহটি উদ্ধারের পর সনাক্ত করা কঠিন হয়ে যায় যে প্রকত পক্ষে মৃত দেহটি কার?

বিশিষ্টজনদের মতে, নারায়ণগঞ্জের প্রতিটি পরিকল্পিত হত্যাকন্ডের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর হত্যাকান্ডের ঘটনাটি প্রকাশ পাচ্ছে। আর যখন প্রকাশ পাচ্ছে তখন হত্যাকন্ডে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম সহ হত্যাকন্ডের সাথে সম্পৃক্ত ঘাতক ও তাঁর সহযোগীরা চিরতরে আত্মগোপনে যাওয়ার পরিকল্পনা তৎমধ্যে বাস্তবায়ন হয়ে যায়। অনেক সময় দেখা যায়, যখন হত্যাকান্ডের বিষয়টি জনসম্মুখে কিংবা দেশের শৃঙ্খলায় নিয়োজিত পুলিশের নজরে আসে তখন না থাকে আলামত এবং পাওয়া যায় না মানব দেহের অংশ বিশেষ, যেমনটা আলোচিত স্বর্ণ ব্যবসায়ী পিন্টু দেব নাথের হাতে নৃশংসভবে হত্যার পর বন্ধু স্বপন সাহার ক্ষেত্রে ঘটেছে।

গত বছর ১৮ জুন কালীর বাজারে স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রবীর ঘোষ নিখোজ হওয়ার ২১ দিনের মাথায় শহরের আমলাপাড়ায় পিন্টু দেবনাথের ভাড়া বাসার সেফটিক ট্যাংক থেকে বস্তা ভর্তি খন্ড খন্ড লাশ উদ্ধার করে জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) পুলিশ। প্রবীর হত্যাকান্ডের পর আলোচনায় আসে তাঁদেরই আরেক বন্ধু স্বপন কুমারের নিখোজের বিষয়টি। ২০১৬ সালেনর ২৭ অক্টোবর কালীর বাজারের ব্যবসায়ী স্বপন কুমার নিখোঁজ হয়। নিখোজ স্বপন কুমর পিন্টু দেবনাথ ও প্রবীর ঘোষের অন্যতম ঘনিষ্ট বন্ধু। প্রবীর হত্যা কান্ডের বিষয়টি জানার পর নিখোজ স্বপন সাহার পরিবার স্বপনের নিখোজের বিষয়ে ডিবি পুলিশের সহায়তা কামনা করে। ডিবি পুলিশের সহায়তায় বেরিয়ে আসে স্বপন সাহার নিখোজের রহস্য। বন্ধু পিন্টু দেবনাথের হাতে নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হয় স্বপন কুমার সাহা। মৃত্যুর ২ বছর পর পরিবার জানতে পারে স্বপন কুমার সাহা খুন হয়েছে তারই বন্ধু পিন্টু দেবনাথের হাতে। প্রবীর ঘোসের মতো স্বপন সাহাকেও হত্যার পর লাশ গুম করার জন্য খন্ড খন্ড করে বাজারের ব্যাগে করে ভাসিয়ে দেওয়া হয় শীতলক্ষ্যা নদীতে।

স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রবীর ঘোষ এবং কালীর বাজারের ব্যবসায়ী স্বপন কুমার সাহা নিখোজ হওয়ার পর নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরী করা হয়। ২০১৬ সালে স্বপন সাহার নিখোজের প্রেক্ষিতে সাধারণ ডায়েরী করে স্বপন সাহার পরিবার। দীর্ঘ ২ বছর অতিবাহিত হলেও থানা পুলিশ স্বপন সাহার নিখোজের বিষয়ে আশানরূপ কোন প্রতিবেদন কিংবা জীবত আছে নাকি মারা গেছে সে সংক্রান্তে কোন তথ্য দিতে পারে নি। তাঁদের দায়িত্ব অবহেলার কারণে নিহতের পরিবারকে দীর্ঘ ২ বছর পর জানতে হয় স্বপন কুমার সাহা আর ফিরে আসবে না (স্বপন কুমার সাহা নিহত হয়েছে)। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছিল নিখোজ স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রবীর ঘোষ ও তার পরিবারের সাথে। স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রবীর ঘোষ নিখোজ হওয়ার পর গত বছর নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করা হয়। সেই সময় নিখোঁজ স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রবীর ঘোষের সন্ধান না পেয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও বিভিন্ন মানবন্ধন করে কালীর বাজারের জুয়েলারী মালিক সমিতি ও স্বর্ণ শিল্পী শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দরা। বিক্ষোভ ও মানবন্ধনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে ঘাতক পিন্টু দেবনাথ। নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানা পুলিশের ব্যর্থতায় পরবর্তীতে নিখোজ প্রবীর ঘোষের উদ্ধারের দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয় জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) পুলিশকে। ডিবি পুলিশের সহায়তায় বেরিয়ে আসে সকল চাঞ্চল্যকার তথ্য। দীর্ঘ ২১ দিন পর উদ্ধার করা হয় প্রবীর ঘোষের খন্ড খন্ড গলিত মরদেহ সেই সাথে স্বপন কুমার সাহার নিখোজের রহস্য উন্মোচিত হয়।

নিখোজ প্রবীর ঘোষের উদ্ধারে সদর মডেল থানা পুলিশ ব্যর্থ হওয়ার পর ডিবি পুলিশের তদন্তে ২১ দিন পর বেরিয়ে আসে নিখোজের মূল রহস্য, অপর দিকে ২০১৬ সালে নিখোজ হওয়ার ২ বছর পর ডিবি পুলিশের হাতধরেই উদঘাটিত হয় স্বপন কুমার সাহার নিখোজের রহস্য। এই দুটি হত্যাকান্ডের পর নগরির বোদ্ধা মহলের প্রশ্ন কাদের ব্যর্থতার কারণে এ সকল হত্যাজঞ্জের মূর মোটিভ দীর্ঘ অপেক্ষার পর উদঘাটিত হলো? দীর্ঘ ২ বছর সময়ের মধ্যেও নারায়ণগঞ্জ মডেল থানা পুলিশ ব্যর্থ হয় স্বপন কুমার সাহার নিখোজের তথ্য উদাঘাটন করতে, স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রবীর ঘোষের নিখোজের বিষয়েও ব্যর্থ তাঁরা। কেন তাঁদের এতো ব্যর্থতা? ডিবি পুলিশ দ্বারা সম্ভব হলে, সদর মডেল থানার দ্বারা কেন সম্ভব হয় না?

অপর দিকে গত বুধবার (১০ এপ্রিল) ফতুল্লা থানার ভোলাইল এলাকার একটি ওয়াল্টনের শো-রুমের নিচে মাটি খুড়ে নিখোজ ঝুট ব্যবসায়ী কামরুজ্জামান চৌধুরীর অর্ধ গলিত লাশ উদ্ধার করে ফতুল্লা থানা পুলিশ। ব্যবসায়ী কামরুজ্জামান নিখোজের ১০ দিন পর লাশটি উদ্ধার করা হয়। লাশ উদ্ধারের পরবর্তী সময়ে ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশ দাবী করেন, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ডণ।

ঘটনা সূত্রে জানা যায়, নিখোঁজের পর নিহত ঝুট ব্যবসায়ী কামরুজ্জামানের পরিবার ফতুল্লা মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী রুজু করেন। সেই জিডির তদন্ত করতে গিয়ে ফয়সাল নামের একজনকে সন্দেহজনক আটক করে পুলিশ। আটক ফয়সালকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করলে তাঁর দেওয়া তথ্যে ভিত্তিকে নিখোজরে ১০ দিন পর উক্ত ব্যবসায়ীর লাশ উদ্ধার করা হয়।

পরিকল্পিত হত্যাকান্ডে বিষয়ে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বির সাথে কথা হলে তিনি দৈনিক সংবাদচর্চাকে বলেন, প্রভাবশালীদের কারনে এ সকল পরিকল্পতি হত্যাকান্ড গুলো সংঘটিত হচ্ছে। ভিকটিমের পরিবার পুলিশ প্রশাসনের সহায়তা নিতে গেলে পুলিশ প্রশাসন আসামীদের রক্ষা করার জন্য উঠেপড়ে লেগে যায়, যার কারনে এ সকল পরিকল্পিত হত্যাকান্ড হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের থানাগুলো বিভিন্ন গুম, খুন, ডাকাতি মামলার মূল রহস্য উদঘাটন করতে না পারলেও জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সেই দিকে সফলতা অর্জন করছে, তাহলে কি থানা পুলিশের চেয়ে জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সামার্থ বেশি এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, জেলা গোযেন্দা শাখা (ডিবি) পুলিশ যে ততটা সফল সেটা বলা যাবে না। তাঁদের নিয়েও অনেক বিতর্ক রয়েছে। তাঁদের সেই বিতর্কের বিষয়গুলো আমার গণমাধ্য সূত্রে থেকে জানতে পারছি, হ্যা এটা সত্য জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) পুলিশে অনেক সৎ ব্যক্তিত্ব রয়েছে যারা যে কোন মামলার মূল মোটিভ কিংবা রহস্য উন্মোচন করার জন্য ব্যাপক চেষ্টা করেন এবং অনেকাংশে তাঁরা সফলতাও অর্জন করেছে। তবে পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের পিছনে সরকারেরও অনেক গাফলতি রয়েছে।

নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষের মতে, থানা পুলিশ অনেক সময় মামলার তদন্তের বিষয়ে গাফলতি করে। তাঁরা যথা সময়ে মামলার তদন্ত কিংবা ভূক্তভোগীদের স্বার্থে কাজ করলে অনেকাংশেই অপরাধ কমে যাবে।

এ বিষয়ে ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ আসলাম হোসেনের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, থানা পুলিশের মামলার বাহিরেও অনেক কাজ রয়েছে, একেক জন তদন্তকারী কর্মকর্তা একাধিক মামলার তদন্ত করে থাকেন তার কারনে অনেক সময় অনেক মামলার রহস্য যথাসময়ে উদঘাটন করা সম্ভব হয় না তবে ডিবি পুলিশ থানা পুলিশ উভয় একটি সংস্থার। তারা আমাদেরই একটি অংশ।

নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করলে তিনিও বলেন, থানা পুলিশের অনেক দায়িত্ব ও কর্মযজ্ঞের কারনে অনেক সময় মূল মামলার মূল মোটিভ উদঘাটন করা সম্ভব হয় না। তবে আমরা সদা জাগ্রত রয়েছে আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করা জন্য।